অটিজম শিশুর আত্মজীবনী…!!!
আমিও একজন শিশু। অটিজম আমার ব্যক্তিত্বের একটি অংশ মাত্র, আমার পুরো স্বত্ত্বাটাই অটিস্টিক নয়। তোমাদের যেমন চিন্তা-ভাবনা, পছন্দ-অপছন্দ, কল্পনা-স্বপ্ন, ভয়-ভীতি রয়েছে আমারও তাই রয়েছে। তোমারও সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে । তুমি মোটা হতে পারো, চোখে কম দেখতে পারো, তোমার একটি পা ছোট হতে পারে; প্রথম দেখাতে এভাবেই তুমি আমার চোখে পড়বে। তাই বলে সেটাকেই আমি তোমার সবটুকু মনে করি না। তোমরা বড়, নিজেদের আবেগ এবং অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারো। আমি অতটা পারি না। তাই বলে আমাকে অবজ্ঞা করো না। এভাবে এক সময় আমার প্রতি তোমাদের প্রত্যাশা এতটাই কমে যাবে যে, আমি আর কিছু করার আত্মবিশ্বাস পাব না।
আমার অনুভূতি এবং চিন্তা-শক্তি তোমাদের মতো সুসজ্জিত নয়। সামান্য কোন দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ; যা তোমাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক, তা আমার কাছে ক্ষেত্র বিশেষে নরক যন্ত্রণার সমতূল্য। তাই আমার আচরণ কখনও তোমাদের কাছে নিষ্ঠুর, নির্বোধ, অথবা অযথা মনে হতে পারে, কিন্তু এটা আমার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মাত্র। এই বয়সেই আমাকে নিজের সাথে কত যুদ্ধ করতে হচ্ছে। তোমরা তা কেন দেখতে পাও না?
আমি কী করতে চাই না, আর কী করতে পারি না তা তোমাদের বুঝতে হবে। ধর পাশের রুম থেকে আমাকে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে কিছু করতে বললে, সেটা আমি হয়তো বুঝতেই পারলাম না। তাই আমার কাছে এসে, আমাকে স্পর্শ করে এবং স্পষ্টভাবে বলো তুমি কী চাও। যেমন, এখন বল রাখো দুপুরের খাবার খেতে হবে। এভাবে বললে আমি ঠিকই বুঝতে পারব।
আমি উপমা, অলংকরণ, তুলনা, বাগধারা এসব বুঝি না। এসব আমাকে কনফিউজড করে দেয়। তোমরা যখন বলো, আরে এটা তো পানির মত সোজা! তখন আমি খুঁজি আশেপাশে কোথায় পানি আছে। যদি বলো এটা তো খুবই সহজ তাহলে আমি সহজেই বুঝতে পারব।
অনেক সময় আমি আমার অনুভূতি ঠিকমত বুঝিয়ে বলতে পারি না। সঠিক শব্দ খুঁজে পাই না। তখন আমাকে দেখেই তোমাকে বুঝে নিতে হবে আমি কেমন বোধ করছি। আমার ক্ষুধা, ভয়, হতাশা, দ্বিধা, উৎকণ্ঠা ইত্যাদি আমার মুখ, শরীরী চলন এবং ইশারা দেখেই বুঝে নিতে হবে। পারবে না?
কোন কিছু শেখাতে চাইলে মুখে না বলে করে দেখাও। শব্দ মনে রাখতে আমার সমস্যা হয়, তবে দৃশ্য মনে রাখতে পারি। তবে এটা ভেবে নিও না যে আমি একবার দেখলেই পারব। আমাকে বারবার করে দেখাতে হতে পারে, সেক্ষেত্রে কি তুমি ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলবে? রেগে যাবে? প্লিজ এমন টি করো না।
আমি অনেক কিছুই পারি, আবার অনেক কিছুই পারি না। যা পারি তার জন্যে উৎসাহ দাও, যা পারি না তার জন্যে ধমক দিওনা। অন্য সবার মত আমারও নিজের পরিচিত পরিবেশে কাজ করতে ভালো লাগে। কিন্তু সবার মত নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। নতুন পরিবেশ আমার ভেতর প্রচণ্ড ভয়ের সৃষ্টি করে। সবসময় মনে হয় সবাই আমাকে বকা দেয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে। তাই আমাকে নিয়ে খুব বেশি এক্সপেরিমেন্ট করো না।
মানুষের সাথে কীভাবে মিশতে হয়, কথা বলতে হয়, খেলতে হয় তার কিছুই আমি জানি না। আমাকে শেখাও। বাইরে যখন ওরা খেলে, আমারও খেলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু আমি খেলি না। কেন, জানো? “আমি খেলতে চাই”, এই কথাটা কীভাবে বলতে হয় সেটাই আমার জানা নেই। আবার ধর কেউ একজন পড়ে গেল, তা দেখে আমি হেসে ফেললাম। তার মানে কিন্তু এই না যে আমি খুব মজা পেয়েছি। কারণটা হলো, আমি জানিই না কী করতে হবে। এক্ষেত্রে, “তুমি ঠিক আছো তো?” এই কথাটি আমাকে বলতে না শেখালে আমি কখনই জানতে পারব না।
মাঝে মাঝে আমি হঠাৎ করেই ভেঙে পড়ি। আমার কাছে তখন সবকিছু ওলোট-পালোট হয়ে যায় । স্বাভাবিক ভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। বেশি চাপের মধ্যে পড়লে আমার এমন হয়। যদি তুমি আমাকে ভালোভাবে বুঝতে পারো, তাহলে এটা এড়ানো সম্ভব। আমার চারপাশ, মানুষজন, পরিবেশ সবকিছু পর্যবেক্ষণ করলে বুঝতে পারবে কোন পরিবেশে, কোন পরিস্থিতিতে, কাদের উপস্থিতিতে আমার এই রকম অবস্থা হয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, আমাকে শর্তহীন ভাবে ভালোবাসবে। আমি এটা পারি না কেন, ওটা পারি না কেন, কেন অন্যদের মত হতে পারি না এসব বলে আমাকে আরো গহীন জটিলতায় ঠেলে দিও না। আমি তোমাদের সমস্ত স্বপ্ন আর প্রত্যাশা মেটানোর সামর্থ্য রাখি না। কী করবো বলো, আমি তো অটিজমকে বেছে নেই নি। তারপরেও হয়তো বা আমি প্রায় স্বাভাবিক একটা জীবন যাপন করতে পারি। তবে তোমাদের সহায়তা ছাড়া সেটি অসম্ভব। অটিজমকে অক্ষমতা না ভেবে বিশেষ রকম সক্ষমতা ভাবো। হ্যাঁ, আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, তোমাদের চোখের দিকে তাকাতে পারি না। কিন্তু এটা কি খেয়াল করেছো, আমি কখনও মিথ্যে বলি না, বোর্ড গেম খেলার সময় চুরি করে জিতি না, অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে দেই না। এগুলো কি বিশেষ গুণ নয়?
আমাকে বিশ্বাস করো, ভালোবাসো, এবং ধৈর্য্য ধারন করো। হয়তো বা আমিও একদিন পারব…”
Category: Speech & Language Therapy
No Comments